নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে গ্যাসের তীব্র সঙ্কটেও গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধ হচ্ছে না। প্রতি বছর যে পরিমাণ গ্যাস চুরি হয় তার অধিকাংশই সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়। মূলত সিস্টেম লস, চুরি ও দুর্নীতি গ্যাস খাতে আর্থিক ক্ষতির বড় কারণ। ওসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণে কোনো সরকারেরই জোরালো তদারকি ছিল না। যে কারণে বছরের পর বছর গ্যাস খাতের আর্থিক ক্ষতি কমাতে শিল্প-বিদ্যুৎসহ নানা খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের সিস্টেম লস (কারিগরি ত্রুটি) কমাতে সরকার পথনকশা তৈরি করেছে। ৭টি গ্যাস কোম্পানিকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সিস্টেম লস কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ওই সময়ের মধ্যে সিস্টেম লস কমপক্ষে অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আর ওই কাজটি না পারলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাসের সিস্টেম লস হয়, তার আর্থিক মূল্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। সরকার চাচ্ছে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সিস্টেম লস অর্ধেকে নামিয়ে আনতে। গত জানুয়ারি মাসে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস ছিল ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানিটিকে ওই হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশে এবং ডিসেম্বরে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে বাখরাবাদের জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ সিস্টেম লস থাকলেও আগামী বছরের জানুয়ারি ও ডিসেম্বরেও কোম্পানিটিকে ওই হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। দেশীয় কোম্পানি, আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও চট্টগ্রামের মহেশখালীতে থাকা দুই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল থেকে মিটারিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস ট্রান্সমিশন পিএলসি লিমিটেডে (জিটিসিএল) গ্যাস সরবরাহ করা হয়। জিটিসিএল পরে মিটারিংয়ের মাধ্যমে ছয় কোম্পানিকে গ্যাস সরবরাহ করে। সেগুলো হচ্ছে তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি। ওসব কোম্পানিই গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে। সিস্টেম লসের মধ্যে তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাসেরই বেশি, যা সুন্দরবন গ্যাস ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসের নেই বললেই চলে।
সূত্র জানায়, সরকার গ্যাস আমদানি করে সরবরাহ সংকট মোকাবেলা করছে। আর আমদানি ও বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান কমাতে দাম বাড়াচ্ছে। অথচ গ্যাস খাতে বিপুল পরিমাণ চুরি ও দুর্নীতি কমাতে পারছে না। তবে এখন থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে কোন কোম্পানি কোন মাসে সিস্টেম লস কতটা নামিয়ে আনবে তা বেঁধে দেয়া হয়েছে। সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে তিতাসের ৩৯১ ও বাখরাবাদের ১৩৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলী গ্যাসে ২০০, জালালাবাদে ৬৪ এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসে ৩৬ জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সিস্টেম লস কমাতে সাতটি ভিজিল্যান্স দল গঠন করা হয়েছে। অবৈধ বিতরণ পাইপলাইন অপসারণ, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং বিচ্ছিন্ন করার পর সেগুলো আবার পুনঃস্থাপিত হয়েছে কিনা ভিজিল্যান্স দল সরেজমিন দেখবে। আর লাইন পুনঃস্থাপনের সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোনো ঠিকাদার জড়িত কিনা তাও চিহ্নিত করা হবে। গত ২৫ জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ২ মাসে ৭০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর প্রায় ২৭ হাজার অবৈধ আবাসিক বার্নার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এসময় ৯৬টি মোবাইল কোর্টসহ ও ১ হাজার ১৮৮টি মোবাইল কোর্ট ছাড়া অভিযান করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ২৫ দফা বেড়েছে। ওই সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (সরকারি-বেসরকারি) ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের দাম ১ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। আর শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ১ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে বিগত সাড়ে তিন দশকে সর্বোচ্চ ৪২ টাকা পর্যন্ত করা হয়েছে। একই সময়ে শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৯ দফা। কিন্তু গ্যাসের বাড়তি দাম দিলেও ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পায়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাসের বিদ্যমান সংযোগে দাম না বাড়ালেও সমপ্রতি শিল্প ও ক্যাপটিভের নতুন সংযোগে ৩৩ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু দেশের গ্যাস খাতে হয়ে আসা অপচয়-চুরি কমেনি। আর গ্যাস সরবরাহও বাড়েনি।
এদিকে দেশে ক্রমেই কমে আসছে গ্যাসের মজুদ। এই সংকট মোকাবেলায় বিগত দেড় দশকে স্থানীয় গ্যাস খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হয়নি। বরং গ্যাসের সরবরাহ সংকট মোকাবেলায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিকে সমাধান হিসেবে দেখা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। বিগত ২০২০ সালের এপ্রিলে স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। পাঁচ বছর পর স্থানীয় সরবরাহ ওই একই জায়গায় আটকে রয়েছে। অথচ এই সময়ে দেশে অন্তত দুই হাজার ঘনফুট গ্যাসের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। ওই চাহিদা মোকাবেলায় স্পট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি অব্যাহত রেখেছে সরকার। ২০১৮ সালের পর থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তার সঙ্গে এ খাতে প্রতি বছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরে এলএনজিতে ভর্তুকি ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা যায়।
অন্যদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও চুরি প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের বাস্তবতা বুঝতে হবে। এখন আর যত্রতত্র গ্যাসের সংযোগ দেয়ার সুযোগ নেই। গ্যাসের মজুদ কমে আসছে, আর সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি বাড়ছে। ফলে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে কম মূল্যে বিক্রি করার সুযোগ নেই। আর গ্যাস চুরির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু কেটে দেয়া সংযোগগুলো পুনরায় জোড়া লাগছে। এ সংযোগ যাতে আর জোড়া লাগতে না পারে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম লস ও চুরি নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
তীব্র সঙ্কটেও দেশে গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধ হচ্ছে না
আগের পোস্ট