নিজস্ব প্রতিবেদক : মুন্সীগঞ্জে কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে প্রায় আড়াই হাজার তৈরি পোশাকের ছোট ছোট কারখানা, যা মিনি গার্মেন্টস হিসেবে পরিচিত। তবে দীর্ঘ বছর ধরে এসব কারখানা গড়ে উঠলেও নেই কোনো নিবন্ধন। সরকারি কোনও নীতিমালার আওতায় না থাকায় ন্যায্য-মজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন এসব কারখানায় কাজ করা প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। তবে মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে মালিকরা বলছেন, ভালো মুনাফা করতে না পারায় তারাও অপারগ। বাজারে পোশাকের দাম না বাড়ায়, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা অবশ্য এগুলোকে কারখানা বলতে নারাজ। তারা বলেছেন, পোশাক তৈরী করা হলেও এগুলো মূলত দর্জি দোকান। কোনো নাম-ঠিকানা নেই। তাই তাদের শৃঙ্খলার আওতায় আনা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দশক ধরে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভা, পঞ্চসার, রামপাল ও বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য মিনি গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকের ক্ষুদ্র কারখানা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাবে, বর্তমানে এসব কারখানার সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। শীত মৌসুম, দূর্গা পূজা ও দুই ঈদের আগে এসব কারখানা থাকে জমজমাট। বর্তমানে আসন্ন রোজার ঈদকে সামনে রেখে এখন চলছে কর্মযজ্ঞ। তৈরি হচ্ছে শিশুদের বাহারি ডিজাইনের পোশাক।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজের চাপের সময় অনেকেই ১৮ ঘণ্টাও কাজ করেন। তবে আশানুরূপ মজুরি পান না তারা। এমনকি সবকিছুর দাম বাড়লেও, গত ৫ বছরে বাড়েনি তাদের অনেকের মজুরি। আবার অফ সিজনে কয়েক মাস এসব কারখানা বন্ধ থাকায় আরেক সঙ্কটে পড়তে হয় শ্রমিকদের। বছর শেষে অনেকের ঘাড়েই চাপে ঋণের বোঝা।
তারা আরও জানান, একজন শ্রমিক তার সহযোগীকে নিয়ে দৈনিক এক ডজন পোশাক সেলাই করতে পারেন। আর আকারভেদে এক ডজন এসব পোশাকের মজুরি পায় তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা।
মিরকাদিমের গোয়ালঘুন্নি এলাকার মাহবুব মিনি গার্মেন্টসের শ্রমিক মোঃ মিনহাজ জানান, এ কাজে পরিশ্রম বেশি, বেতন কম। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই কাজ করে পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এর মধ্যে হেলপারকে দিতে হয় ২০০ টাকা আর আমি পাই ৩০০-৪০০ টাকা।
মেসে খাওয়ার বিল দু’জনের (সহযোগীসহ) ৩০০ টাকা। তার ওপর সংসার চালাতে হয়। এই টাকায় আমি হেলপারকে কী দেবো, আর আমিই বা কী রাখবো? আমরা এখানে যতটুকু টাইমে কাজ করি, সেই সময় অন্য কোথাও কাজ করলে আরও বেশি বেতন পাবো। এই ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে কীভাবে সংসার চালবো তা নিয়ে থাকি দুশ্চিন্তায়। তার মতো আরও একাধিক শ্রমিকের একই ভাষ্য।
শাঁখারিবাজার এলাকার অপর কারখানার শ্রমিক রাজিব হাসান বলেন, ‘এখন ঈদের মাল তৈরি করছি। এই সময়ে চাহিদা অনেক বেশি থাকে, এজন্য কাজের অনেক চাপ।
সদটের সুখবাসপুর এলাকার রাসেল মিনি গার্মেন্টসের শ্রমিক (কাটিং মাস্টার) আবেদ আলী জানান, এখানে ১১ বছর ধরে কাজ করি। মাসে বেতন পাই সাড়ে ১১ হাজার টাকা। দেশের সব শ্রমিকদের বেতন বাড়লেও আমাদের এখানে বেতন বাড়েনি। ফলে ঋন নিয়ে সংসার চালাতে হয়।
রাসেল গার্মেন্টসের মহিলা শ্রমিক শিলা আক্তার জানান, আমরা প্রতিদিন ৩০ ডজন করে মাল প্যাকেট করি। কাজ বেশী থাকলে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। কাজ না থাকলে তা অর্ধেকে নেমে যায়।
মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুন্নি এলাকার মোঃ মাহবুব আলম মিনি গার্মেন্টসের মালিক জানান, এখন আমরা রমজানের ঈদের পোশাক তৈরি করছি। বর্তমানে কাঁচামালের দামও অনেক বেড়ে গেছে। এই ঊর্ধ্বমূল্যের জন্য সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পোশাক শিল্প।
রাসেল মিনি গার্মেন্টসের মালিক মো. রাসেল শেখ জানান, এখন ঈদের কাপড় তৈরি হচ্ছে। এগুলো নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকার সদরঘাট, টাঙ্গাইলের করোটিয়াহাট, কিশোরগঞ্জের ভৈরবহাটে-ই মূলত বেশি বিক্রি করি। এই ব্যবসায় প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়। এখানে প্রচুর খরচ হয় কিন্তু সে অনুপাতে ব্যবসা হয় না।
মুন্সীগঞ্জ বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, মুন্সীগঞ্জ সদরে অসংখ্য মিনি গার্মেন্টস রয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার রেডিমেড কারখানা রয়েছে, যারা পোশাক তৈরি করে থাকে। এসব কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক পোশাক তৈরির কাজ করেন।
এসব কারখানায় শ্রমিক মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক জাবেদা খাতুন জানান, মুন্সীগঞ্জের সদরের ২ হাজার ৫শত ক্ষুদ্র কারখানার নিবন্ধন নেই। এসব কারখানাকে নোটিশ প্রদান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের জবাব দিতে সময় বেঁধে দেবো।
এছাড়া শ্রমিকদের বেতনের বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদের ডেকে সমাধান করার চেষ্টা করা হবে। তবে বেতনের বিষয়ে কোনও শ্রমিক অভিযোগ করেনি। তারপরও বিষয়টি নজরদারি করা হবে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এসব কারখানাকে মিনি গার্মেন্টস বললে ভুল হবে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এগুলো দর্জি কারখানা। কেননা, কারখানায় মিনিমাম ৫ জন শ্রমিক থাকতে হবে, প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা এবং মালিকেরও নাম থাকতে হবে। সেখানে কিছুই নেই। তবে এগুলোর তালিকা করা হচ্ছে।
এছাড়া মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে অনুরোধ করেছি, আপনার প্রতিষ্ঠানের একটি নাম দিতে হবে। যেহেতু নাম-ঠিকানা নেই, সেহেতু কোনও কিছুই করতে পারছি না। একটি লাইসেন্স করতে গেলেও নাম লাগে। এই বিষয়ে ৭-৮ জনের একটি কমিটি গঠন করা হবে। তখন আরও ভালোভাবে তদারকির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যাবে।