কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : তরমুজ উত্তোলনের মৌসুমের শুরুতেই জমে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকার তরমুজের আড়ৎ। ওই স্থানের ১০/১২টি আড়তে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার তরমুজ। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত এখানে বসে তরমুজ বিক্রির হাট। এ স্থানটির পাশেই ধলেশ্বরী নদী, অপর পাশে মুন্সীগঞ্জ শহরে প্রবেশের মূল সড়ক হওয়ায় সহজেই নদী ও সড়ক পথে এ স্থানে আনা যায় তরমুজ। যার ফলে এখানে মৌসুমের শুরুতেই প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার তরমুজ। দিন বাড়ার সাথে সাথে তরমুজের আমদানি ও বিক্রি আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ীরা।
মুক্তারপুর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে এখানে জমে উঠে জমজমাট তরমুজের হাট। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাক-ডাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুখরিত থাকে পুরো এলাকা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরমুজ আসে এ হাটে। একটি ট্রাক আড়তে আসার সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আড়তের শ্রমিক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা। ট্রাক থেকে হাতে হাতে নামানো হয় এই তরমুজগুলো। আর ট্রলার থেকে আড়তে উঠানো হয় ঝুপড়ি ভরে। নামানোর সময় সাইজ অনুসারে আড়তের সামনে ১০০ থেকে ১৫০টি করে তরমুজ একেক স্থানে স্তুপ করা হয়। বড় সাইজগুলো এক স্থানে, মাঝারিগুলো এক স্থানে এবং ছোটগুলো আরেক স্থানে। এভাবে ট্রাক এবং ট্রলার থেকে তরমুজ নামিয়ে স্তুপ করা হয় আড়তের সামনে। পরে সেগুলোকে সাইজ অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা যায়, ওই আড়তে সবচেয়ে বড় সাইজের তরমুজ ৫০০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মাঝারি সাইজেরগুলো ৪০০, ৩৫০, ৩০০ টাকা এভাবে একেবারে ছোট সাইজেরগুলো ৩০-১০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজার ছাড়াও পাশের নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, চাঁদপুর, কুমিল্লা, গাজীপুর জেলার পাইকাররা এই আড়তে এসে তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কেউবা আবার ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছে। তরমুজ ছাড়াও কিছু বাঙ্গিও বিক্রি হয় এই আড়তে।
কৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা উভয়ে তরমুজ নিয়ে আসেন এ হাটে। আড়তদাররা তাদের আড়তের সামনে ১০০ হতে ১৫০টি আলাদা আলাদা সাইজের তরমুজ স্তুপ করে ডাকেন ক্রেতাদের। ডাক শুনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা এসে ভিড় করেন। একজন প্রতি পিস তরমুজের দাম ডাকতে শুরু করেন। বড় তরমুজগুলো প্রথমে ৪০০ টাকা করে ডাকা শুরু হয়। কেউ ৪০০ টাকায় নিতে রাজি হলে তখন আবার ৪১০ টাকা পিস বলে ডাকতে শুরু করেন। ৪১০ টাকায় কোনো পাইকার নিতে রাজি হলে তখন তিনি একই তরমুজ ৪২০ টাকা করে ডাকতে শুরু করেন। এভাবেই তরমুজ সর্বোচ্চ দামে যে কিনতে রাজি হন তার কাছে একসঙ্গে একেক স্তুপে থাকা ১০০ থেকে ১৫০টি তরমুজ বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক ও ট্রলার থেকে শ্রমিকরা নামাতে শুরু করেন তরমুজ ও বাঙ্গি। বিভিন্ন সময়ে তরমুজ চাষি ও ব্যবসায়ীরা ট্রলারে ভরে তরমুজ, বাঙ্গি এনে নদীর ঘাটে ভিড়িয়ে রাখেন। পরে তারা এ সমস্ত তরমুজ ও বাঙ্গি ভোর ৬টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এখানকার আড়তগুলোতে তুলে বিক্রি করতে শুরু করেন। এক ট্রলার তরমুজ বিক্রি করতে অনেকের কয়েকদিনও লেগে যায়। এসব বাঙ্গি-তরমুজ কেনার জন্য মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর থেকেও পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এখানে আসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুম পড়ে যায় বেচাকেনার।
আড়ৎ মালিক সমিতি, ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬ থেকে ৭ বছর আগে দু-একজন আড়তদার এখানে আড়ৎ পেতে বসেন। সেসময় দু-চারজন ব্যবসায়ী ও কৃষক তাদের উৎপাদিত বাঙ্গি-তরমুজ নিয়ে আসতেন। তখন ক্রেতা ও বিক্রেতা ছিল খুব কম। তবে গত তিন বছরে পাল্টে গেছে এ চিত্র। ব্যাপকভাবে বেড়েছে বেচাকেনা। বেড়েছে আড়ৎ ও ক্রেতা-বিক্রেতা। প্রতিদিন বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা থেকে এই হাটে আসে একলাখ পিস তরমুজ। ভরা মৌসুমে দুই লাখেরও বেশি তরমুজের সমাগম হয় এই হাটে। মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাসহ, কুমিল্লা, চাঁদপুর থেকে আসে বাঙ্গি।
এই আড়তে তরমুজ বিক্রি করতে আসা পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালি এলাকার কৃষক গোবিন্দ চন্দ্র দাস বলেন, এ বছর তরমুজের চারা রোপণ মৌসুমে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় ২৫ পার্সেন্টের মতো চারাগাছ নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া তরমুজ আনতে পরিবহণ খরচ অনেক বেড়েছে। শ্রমিক, সার সবকিছুর দাম বেশি। আমাদের এ বছর প্রতিটি তরমুজ উৎপাদন করতে ১০০ টাকার মতো খরচ হয়েছে। দাম বেশি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবেমাত্র তরমুজ উঠতে শুরু করেছে। সামনে দাম কমে যাবে।
অপর কৃষক রকি মিয়া বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। তাই আমাদের তরমুজ উৎপাদন করতে খরচ বেশি হয়েছে। এছাড়া এ বছর বৃষ্টিতে অনেক গাছের চারা মরে গেছে। তাই এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় তরমুজ কম হয়েছে।
টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও বাজারের তরমুজ বিক্রেতা বিল্লাল বলেন, আমি প্রতি তিনদিন পরপর এই বাজারে আসি তরমুজ কিনতে। এ বাজারে প্রচুর পরিমাণে তরমুজ ওঠে এবং সারাদিন তরমুজ পাওয়া যায়। সব সাইজের তরমুজ এখানে সবসময় পাওয়া যাওয়ায় দূর-দূরান্ত হতে পাইকারা এখানে তরমুজ কিনতে আসেন।
মায়ের দোয়া আড়তের মালিক মোঃ জনি গাজী বলেন, আমাদের এখানে ১০/১২টি আড়তে এ মৌসুমে তরমুজ বিক্রি হয়। এখানে নদী ও সড়ক উভয় পথে তরমুজ আসে। প্রতিদিন সকাল হতে রাত পর্যন্ত তরমুজের বেচাকেনা চলে। আমি নিজে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার তরমুজ বিক্রি করি। এখানকার সব আড়ৎ মিলে প্রতিদিন এখানে এক কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়।