নিজস্ব প্রতিবেদক : ঈদুল ফিতরের ছুটিকে ঘিরে পদ্মা সেতু এলাকা ও পদ্মা পাড়ের বিনোদন কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে এখন দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা ভাসছেন ছুটির আমেজে। ঈদের ছুটিতে লৌহজংয়ের শিমুলিয়া ঘাট, পদ্মা সেতু এলাকা, ঘোরদৌড় বাজার পুরান থানা, শামুরবাড়ী, সিনহার বাড়ি, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও স্পিডবোটে ভ্রমণ, পদ্মার চরে নয়নাভিরাম দৃশ্য, সবুজের সমারোহে সব বয়সী মানুষের আগমনে উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু এবং ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কারণে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া, মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে গেছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মা পাড়ে বাড়ছে পর্যটক ; গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্থাপনা। মাওয়া প্রান্তের লৌহজংয়ের বিচ্ছিন্ন পদ্মার চরেও গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। শিবচর ও জাজিরা প্রান্তেও পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়েছে। প্রমত্তা পদ্মার সৌন্দর্য আর অনুপম পদ্মা সেতু হয়ে উঠেছে পর্যটকের অন্যতম আকর্ষণ।
জানা গেছে, লৌহজং উপজেলার পদ্মা তীরের ভ্রমনপিপাসুদের কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে, আবার কেউ বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে। কেউ সেলফি আবার কেউ গা ভাসাচ্ছেন পদ্মার জলরাশিতে। ট্রলারযোগে গান বাজিয়ে তীর ঘেঁষে এদিক-সেদিক ছুটছে কিশোর-যুবকরা। সবাই ঈদ আনন্দে উৎফুল্ল। নদী তীরের নয়নাভিরাম পরিবেশ আর মানুষের মিলন মেলায় যেন আরেকটি মিনি কক্সবাজারে রূপ নিয়েছে পদ্মার তীর।
শিমুলিয়া ঘাট ও শামুরবাড়িতে বসেছে হরেক রকম খেলনার দোকান ও নাগরদোলা। উপজেলার কলমা ইউনিয়ন থেকে শিমুলিয়া পদ্মা সেতু এলাকা পর্যন্ত পদ্মার পাড়ে বিনোদন কেন্দ্রগুলো সরেজমিনে ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
এদিকে শিমুলিয়া ঘাটে ঈদে বেড়ানোর আনন্দ নিতে আসছেন বহু পর্যটক। এবারের ঈদে রাজধানীর নগরজীবন ছেড়ে অনেকেই আসছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। তাই গভীর রাত অবধি হোটলগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়।
পদ্মা নদীর তীরে ঈদ উদযাপনে বিনোদনপ্রেমীদের কাছে অন্যতম স্পটে পরিণত হয়ে উঠেছে পদ্মার পাড়। একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালুময় ঢালু তীরে। পাশেই পদ্মার চরে ঘাস বন, হিমেল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সবুজ ঘাস। এ যেন এক সমুদ্র সৈকত।
ধানমন্ডি থেকে শিমুলিয়া ঘাটে ঘুরতে আসা কলেজ ছাত্রী সাবিনা হক বলেন, পদ্মা সেতু দেখতে এলাম। পদ্মার পাড়ে এত বাতাস, মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো বাতাস। ভাইয়া ও আম্মুর সঙ্গে এসেছি, ভালো লাগছে।
কামরুল সিকদার বলেন, পদ্মার পাড়ে মৃধাবাড়ী ও শামুরবাড়ির এ জায়গাটি অপূর্ব। গত কয়েক বছর ধরে এখানে বালিগাঁও থেকে ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি।
আশিক ইসলাম বলেন, সুবচনী থেকে ট্রলারে করে বন্ধুরা সবাই মিলে পদ্মা নদীতে ঘুরতে এসেছি। আমরা পদ্মার চরে নেমে গোসল করলাম।
ঢাকা থেকে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসা ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন বলেন, জেলায় বিনোদন কেন্দ্রের অভাবে মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই। এ জায়গাটি সুন্দর। নদীর পাড়ের স্নিগ্ধ পরিবেশ, শীতল বাতাস সবারই ভালো লাগবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটনের পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্যেও এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে মুন্সীগঞ্জ, ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। বর্তমানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্পটে পরিণত হয়েছে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্ত।
পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলার গ্রামীণ এলাকায় শহরের আবহ তৈরি হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পর থেকেই মুন্সীগঞ্জের তিনটি উপজেলার প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। মানুষের জীবনযাত্রার মানেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
পদ্মা পাড়ের বাসিন্দারা জানান, সেতু চালু হওয়ার পর দুই প্রান্তে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। লৌহজংয়ে জেগে ওঠা পদ্মার চরে গড়ে উঠেছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। সেতু চালুর পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই আসছে অসংখ্য মানুষ। ফলে আগের পেশা বদল করে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের অনেকেই এখন পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করছেন।
শরীয়তপুরের নওডোবা মোড়ে ফুড এক্সপ্রেস নামে রেস্তোরাঁর তরুণ উদ্যোক্তা তারিক আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে খাবার ও বিনোদন কেন্দ্রের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সেতু উদ্বোধনের পর দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। তার বিক্রিও বেড়েছে। সেতুসংলগ্ন সড়কে এখন রেস্তোরাঁ ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গার মোড়ে গোলচত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কয়েকটি স্পট। একই অবস্থা মাদারীপুরের শিবচরেও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ঈদের ছুটিতেই নয়, শুক্র ও শনিবার এই এলাকায় দর্শনার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হয়। মাওয়া প্রান্ত থেকে শুধু সেতু দেখতেই প্রতিদিন ৩০টির বেশি স্পিডবোট ছেড়ে যায়। প্রতিটি স্পিডবোট অন্যান্য দিন দুই-একটি ট্রিপ পেলেও সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে ১০-১২টির বেশি ট্রিপ হয়।
স্পিডবোট চালক শামসুদ্দিন বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দুপুরের পর থেকে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। তবে সেতুর নিরাপত্তার স্বার্থে কাছে ঘেঁষতে পারছেন না তারা।
কয়েকজন হকার ও খাবার বিক্রেতা জানান, পদ্মা সেতু দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। ঈদ বা ছুটির দিনে তাদের বেচাকেনা দ্বিগুণের বেশি হয়।
মাওয়ার হোটেল ব্যবসায়ী আলিফ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে জনসমাগম বেশি। সেতুকে কেন্দ্র করে মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট এখন পর্যটনের কেন্দ্রস্থল।
লৌহজং উপজেলার মাওয়ার বাসিন্দা হুমায়ুন আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতু দেখতে মাওয়া প্রান্তের পদ্মাপাড়, শিমুলিয়া ফেরিঘাটসহ আশপাশের এলাকা পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। ফলে ফেরিঘাট এলাকায় নতুন নতুন হোটেল-রেস্তোরাঁ তৈরি হচ্ছে। পদ্মার তীরে বসে রুপালি ইলিশ ভাজা খেতে খেতে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখার মুহূর্ত অন্য রকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। পদ্মা সেতুকে ফ্রেমের পেছনে রেখে মোবাইল ফোনে সেলফিসহ নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন দর্শনার্থীরা।
হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের ভাষ্য, পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর থেকে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে রেকর্ডসংখ্যক পর্যটক আসছেন। তারাই এখন মাওয়ার শিমুলিয়া ফেরিঘাটের হোটেল-রেস্তোরাঁর মূল গ্রাহক। তাই ঘাটকেন্দ্রিক খাবারের ব্যবসা বেশি জমেছে।